
দ্রুত বদলে যাওয়া জীবনযাপন, ফাস্টফুডে অভ্যস্ততা আর কায়িক পরিশ্রমের ঘাটতি— এই তিন মিলে নীরবে বাড়ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি। বয়স নির্বিশেষে, এমনকি শিশু ও তরুণদের মধ্যেও রক্তনালীর রোগ ও স্ট্রোকের আশঙ্কা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, “লাইফস্টাইল-সম্পর্কিত পরিবর্তন” এখন স্ট্রোকের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোববার (২ নভেম্বর) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগ আয়োজিত বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উপলক্ষ্যে এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন বক্তারা।
সেমিনারে আধুনিক জীবনযাত্রা, কায়িক শ্রমের অভাব এবং পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকদের মতে, অল্প বয়সেই রক্তনালীর পরিবর্তন ও দুর্বলতা শুরু হচ্ছে— যা একসময় স্ট্রোকে রূপ নিচ্ছে।
এসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সুমন রানা বলেন, স্ট্রোকের মূল সমস্যা আসলে লাইফস্টাইলের সমস্যা। মোবাইল ব্যবহারের সঙ্গে স্ট্রোকের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও, মোবাইল আমাদের বসিয়ে রাখে— আমরা হাঁটি না, দৌড়াই না, নড়াচড়া করি না। ফলে শরীরে স্থবিরতা আসে, যা ধীরে ধীরে রক্তনালী ও মস্তিষ্কের ক্ষতি করে।
তিনি যোগ করেন, মোবাইল থেকে নির্গত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা রেডিয়েশনের সঙ্গে স্ট্রোকের কোনো প্রমাণিত সম্পর্ক এখনো পাওয়া যায়নি। ডা. সুমন রানা বলেন, শিশুদের মধ্যেও স্ট্রোকের ঘটনা বাড়ছে। প্রতি একলাখ জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে দুই জনের স্ট্রোক শনাক্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের স্ট্রোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ময়াময়া ডিজিজ। এটি একধরনের জন্মগত (জেনেটিক) রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো ধীরে ধীরে সরু হয়ে যায়। এর ফলে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়ে স্ট্রোক দেখা দেয়— কখনও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে, আবার কখনও রক্তক্ষরণের কারণে।
হাসপাতালটিন অ্যান্ডোভাস্কুলার অ্যান্ড স্ট্রোক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোতাশিমুল হাসান (শিপলু) বলেন, এখনকার শিশুদের খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ফাস্টফুডই তাদের প্রধান খাবার হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে কায়িক পরিশ্রম নেই, খেলা বা দৌড়ঝাঁপও নেই। এই দুই মিলেই খুব অল্প বয়সে রক্তনালী শক্ত ও সরু হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সময় বিকেলে মাঠে দৌড়ানো ছিল অভ্যাস। এখনকার বাচ্চারা মোবাইল বা ট্যাব হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। ফলাফল অকাল বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা আর স্ট্রোকের ঝুঁকি।
স্ট্রোকের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো সম্পর্কে ডা. শিপলু বলেন, এগুলো দুই ভাগে বিভক্ত, প্রাইমারি ফ্যাক্টর (যা পরিবর্তন করা যায় না) এবং মডিয়াবল ফ্যাক্টর (যা পরিবর্তনযোগ্য)।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “বয়স বা লিঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আর রক্তে চর্বির মাত্রা (হাইপারলিপিমিয়া) নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিলে স্ট্রোকের বড় অংশই প্রতিরোধ করা যায়।”
সেমিনারে স্ট্রোক পুনর্বাসনে সময় ব্যবস্থাপনা ও দলগত উদ্যোগের গুরুত্বারোপ করে হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, আর্লি রিহ্যাবিলিটেশন মানে আর্লি গুড আউটকাম—অর্থাৎ, যত তাড়াতাড়ি পুনর্বাসন শুরু করা যায়, রোগীর আরোগ্য তত দ্রুত হয়। বিলম্বে শুরু করলে রিকভারি স্লো হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের ফলাফলও খারাপ হয়।
তিনি জানান, রক্ত জমাট বাঁধাজনিত স্ট্রোকের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুরু করা উচিত, আর রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু করা ভালো।
কোনো রোগীকে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগে রেফার করার আগে কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হয়— রোগীকে হিমোডাইনামিক্যালি স্টেবল থাকতে হবে, স্ট্রোক প্রক্রিয়া বন্ধ থাকতে হবে, গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে এবং রোগীকে অন্তত কিছুটা সচেতন থাকতে হবে যাতে সে নির্দেশ বুঝতে পারে।
তিনি আরও বলেন, স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়। এটি ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট ও চিকিৎসকদের সমন্বিত টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ ধরনের দল ইতোমধ্যে কাজ করছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় স্ট্রোক-সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে স্ট্রোক বিষয়ে একটি টপিক থাকলেও, সেখানে পর্যাপ্ত তথ্য নেই এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সময় অবশ্যই ফিজিশিয়ানদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
তিনি আরও যোগ করেন, পাঠ্যপুস্তকে শিশুদের স্পোর্টস ইনজুরি, ট্রমা, ব্যাক পেইন এবং নেক পেইন সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান থাকা দরকার। এতে তারা ছোট থেকেই নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হবে।
