ঠাকুরগাঁওয়ে স্কুলশিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় সড়ক অবরোধ
ঠাকুরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় রাকেশ রায় (১৪) নামে এক স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ সহপাঠীরা নিহত রাকেশের মরদেহ রাস্তায় রাখেন এবং দোষীদের গ্রেপ্তারসহ ছয় দফা দাবিতে প্রধান সড়ক অবরোধ করেন।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এই অবরোধে স্থবির হয়ে পড়ে গড়েয়া–ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক সড়কের যান চলাচল। পরে প্রশাসন ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে রাত ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন।
মঙ্গলবার দুপুরে এস.সি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকেশ রায় স্কুল ছুটি শেষে বাইসাইকেলে বাড়ি ফিরছিল। পথে একটি নসিমন তাকে সজোরে ধাক্কা দিলে সে সাইকেলসহ ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হয়। সহপাঠীরা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাকেশ গড়েয়া ইউনিয়নের গোপালপুর দেউনিয়া বাজার এলাকার মৃত নিরঞ্জন রায় ও জুথী রাণী দম্পতির ছোট ছেলে।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সহপাঠীরা ছুটে আসে এবং রাস্তায় রাকেশের নিথর দেহ দেখেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের অভিযোগ, “কর্তৃপক্ষের অবহেলা” এবং স্কুলের গেটম্যানের দায়িত্বহীনতার কারণেই রাকেশের মৃত্যু হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি ছিল –
১. রাকেশের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি।
২. ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী দাফন – সৎকারসহ পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ।
৩. দায়িত্বে অবহেলার কারণে স্কুলের গেটম্যানকে চাকরি থেকে বহিষ্কার।
৪. রাকেশের পরিবারের একজনকে চাকরি প্রদান।
৫. স্কুলের সামনে স্পিডব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ।
৬. স্কুল প্রশাসনের ক্ষমা প্রার্থনা এবং ম্যানেজিং কমিটি বাতিল।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, প্রতিদিন ভয় নিয়ে স্কুলে আসতে হয়। সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ নেই, নিরাপত্তা নেই। “আমরা পরীক্ষা চাই, ক্লাস চাই-কিন্তু তার আগে চাই নিরাপদ সড়ক,”- বলেছে তারা।
রাকেশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন পুরো পরিবার। দুই বছর আগে হৃদরোগে মারা যান রাকেশের বাবা নিরঞ্জন রায়। সংসারের অভাব–অনটনের মধ্যে রাকেশ ছিল মায়ের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। তার বড় ভাই পংকজ রায় পড়াশোনার পাশাপাশি স্থানীয় একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন, আর মা জুথী রাণী দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান।
মা জুথী রাণী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “রাকেশ ছিল আমার ভরসা। বলত মা, আমি বড় হয়ে তোমার সব দুঃখ দূর করব। সকালে স্কুলে পাঠাই, সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ফিরে আসে। আমার ছেলেটার দোষ কী ছিল? আমি বিচার চাই-যেন আর কোনো মা এভাবে সন্তান না হারায়।”
ভাই পংকজের কণ্ঠেও ক্ষোভ ও বেদনার ঝাঁজ-
“প্রতিদিন ভাবি কষ্ট কমবে, কিন্তু আজ সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এভাবে কি রাস্তায় বের হলেই মরতে হবে?”
প্রতিবেশীরা জানান, রাকেশ ছিল অত্যন্ত মেধাবী। তার ঘর, বইয়ের ব্যাগ, পড়ার টেবিল-সব যেন এখন নিথর ও স্তব্ধ।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি মো. সরোয়ারে আলম খান বলেন,
“ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে উত্তেজিত ছিল, আমরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করায় অবরোধ তুলে নেয় তারা।”
তিনি আরও জানান, নসিমনচালককে শনাক্তের চেষ্টা চলছে এবং তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে – সেজন্য ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
