কুরআন–হাদিসের আলোকে শীতকালের আমল

শীত—আল্লাহর সৃষ্টি করা এক বিশেষ ঋতু। বাহ্যিকভাবে এটি কঠিন মনে হলেও, মুমিনের জন্য শীত আসলে বিশাল রহমত। শীতের দীর্ঘ রাত ও সংক্ষিপ্ত দিন ইবাদত বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। তাই সাহাবা ও সলফে সালেহীন শীতকে বলতেন— ‘শীত মুমিনের ইবাদতের বসন্ত কাল।’

আসুন শীতকালের বিশেষ কিছু আমলের কথা জেনে নিই-

১. শীতে তাহাজ্জুদ
শীতে রাত লম্বা হয়—তাহাজ্জুদের জন্য এটি চমৎকার সময়। তাহাজ্জুদ নামাজ শীতের দীর্ঘ রাতের সেরা আমল। হযরত ইবনু রাজব (রহ.) বলেন—

‘শীত মুমিনের ইবাদতের বসন্ত কাল। রাতে ইবাদতের জন্য সময় দীর্ঘ, দিনে রোজার জন্য সময় কম।’

২. শীতে জামাতে নামাজ আদায়
শীতকালে তীব্র ঠাণ্ডায় ফজর ও এশার সালাত জামাতে আদায় কষ্টকর। শীতের ঠান্ডার কারণে অনেকে মসজিদে যেতে কষ্ট অনুভব করেন। শীতকাল—ফজর ও এশার সময় অন্ধকার থাকে—ফজিলত আরও বাড়ে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

بَشِّرِ المَشَّائِينَ فِي الظُّلَمِ إِلَى المَسَاجِدِ بِالنُّورِ التَّامِّ يَوْمَ القِيَامَةِ

‘অন্ধকারে যারা মসজিদে যায়, তাদের কিয়ামতের দিনে পূর্ণ নূরের সুসংবাদ দাও।’ (মুসলিম)

৩. শীতে ওজু
শীতকালে ঠান্ডার মধ্যেও সুন্দরভাবে ওজু করা। শীতে ওজু অনেকের কাছে কষ্টকর, আর এই কষ্টের মধ্যেই রয়েছে বিরাট সওয়াব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

إِسْبَاغُ الوُضُوءِ عَلَى المَكَارِهِ

‘কষ্টের মধ্যে সম্পূর্ণ ওজু করা (বিরাট) সওয়াব।’ (মুসলিম)

৪. শীতকালীন রোজা
শীতকালীন রোজা পালনে সহজ কিন্তু অতুলনীয় ফজিলত। শীতে দিন ছোট থাকে, তাই রোজা রাখা সহজ। নবীজি (সা.) বলেছেন—

الصَّوْمُ فِي الشِّتَاءِ الغَنِيمَةُ البَارِدَةُ

‘শীতের রোজা হলো ঠান্ডা লাভ (সহজ উপার্জন)।’ (মুসনাদ আহমদ)

৫. শীতের কষ্ট দূর করতে দোয়া করা
শীত আসলে রোগ, কষ্ট সব কিছু থেকেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা সুন্নাহ। নবীজি (সা.)গরম ও ঠান্ডা দুটো থেকে রক্ষা চেয়ে দোয়া করতেন—

اللَّهُمَّ أَذْهِبْ عَنَّا حَرَّهَا وَبَرْدَهَا

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আজহিব আ’ন্না হার্রাহা ওয়া বারদাহা।’

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের থেকে এর তাপ আর শীত দূর করো।’ (মুসনাদে আহমদ)

৬. শীতকালীন যাবতীয় রোগ থেকে বাঁচতে দোয়া

এটি শীতের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মের খরতাপের ফলে সৃষ্ট যাবতীয় মহামারী ও রোগ থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া শ্রেষ্ঠ দোয়া। এটি সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য। নবীজি (সা.) প্রতিদিন এ দোয়া করতেন—

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ البَرَصِ وَالجُنُونِ وَالجُذَامِ وَمِن سَيِّئِ الأَسْقَامِ

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল ঝুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সাইয়্যিইল আসক্বাম।’

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! অবশ্যই আমি তোমার কাছে ধব্বল, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার কঠিন ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবু দাউদ)

৭. গরিব–অসহায়দের সাহায্য—শীতের সেরা দান
শীতে গরিবদের কষ্ট বেড়ে যায়। তাই তাদের সাহায্য করা উত্তম সাদকা। এই সময় গরম কাপড়, কম্বল, খাবার—এসব দেওয়া মহান সওয়াবের কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا

‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাদ্য দেয় মিসকিন, ইয়াতিম ও বন্দিকে।’ (সুরা আল–ইনসান: আয়াত ৭)

৮. জিকির ও তিলাওয়াত
শীতে শরীর অনেক সময় স্থবির হয়ে যায়, কিন্তু জিহ্বা সক্রিয় থাকে—জিকির তাই সহজ। আল্লাহ তাআলা বলেন—

یٰۤاَیُّهَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡكُرُوا اللّٰهَ ذِكۡرًا كَثِیۡرًا

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো।’ (সুরা আহযাব: আয়াত ৪১)

৯. সালাম প্রচার
শীতে একাকিত্ব বাড়ে, মানুষ ঘরের ভেতর থাকে, সম্পর্ক কমে— সালাম সম্পর্ক জাগ্রত রাখে, হৃদয় ও সমাজ উষ্ণ করে। এছাড়াও নবী (সা.) বলেন—

أَفْشُوا السَّلَامَ

‘তোমরা সালাম প্রচার করো।’ (মুসলিম)

১০. শীতের কষ্টে ধৈর্য ধারণ
ধৈর্য হলো ইমানের অর্ধেক। আর শীতের কষ্ট আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহাপরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ

‘ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৫৫)

শীতের ঠান্ডা শুধু দেহকে কাঁপায় না বরং মানুষের হৃদয়কেও নরম করে। তাই এই ঋতুতে মুমিন বেশি ইবাদত করে, বেশি নামাজ পড়ে, বেশি রোজা রাখে, বেশি দান করে, বেশি জিকির করে এবং আল্লাহর আরও কাছে চলে আসে। শীতের প্রতিটি দিনই প্রত্যেক মুমিনের নেক আমল বাড়ানোর সুযোগ— তাহাজ্জুদ, রোজা, ওজু, সালাত, দোয়া, দান—সবই সহজ, সবই বরকতময়। আল্লাহ আমাদের শীতকালকে ইবাদতপূর্ণ, রহমতপূর্ণ ও নেক আমলের মৌসুম বানিয়ে দিন। আমিন।

Read Previous

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ সমর্থন করে না বাংলাদেশ: নিরাপত্তা উপদেষ্টা

Read Next

স্কুলে ভর্তি: জালিয়াতি ধরা পড়লে আবেদন বাতিল

Most Popular